" মা! ও মা! আমাকে এখানে রেখে যেও না। তোমার পায়ে পড়ি মা!"
" তুমি এখানেই ভালো থাকবে। এরা তোমাকে অনেক ভালোবাসবে। তিনবেলা খেতে দিবে, সুন্দর কাপড় পরিধান করতে দিবে। মা হয়ে বছরে যা দেইনি তারা সব দিবে।"
" আমার কিছুই চাই না মা! আমার শুধু তোমাকে চাই। তোমার চাঁদমুখ দেখলেই আমার ক্ষুধা চলে যাবে, তোমার হাসি দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে মা! এতো নিষ্ঠুর হয়ো না মা।"
অশ্রুসজল নয়নে মায়ের দু'পা জড়িয়ে আর্তনাদ করছে আট বছরের বাচ্চা রাফিয়া। অন্তরে পাথর চেপে, আবেগ বিসর্জন দিয়ে মেয়ের আর্তনাদ উপেক্ষা করে চলে যায় নুসরাত।
অভাবের সংসারে দু'মুঠো ভাত মেয়ের মুখে তুলে দিতে পারে না নুসরাত। মেয়ের শুকনো মুখের দিকে যতবার তাকায় ততবার অন্তত চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় তার। আট বছর স্বামীহীনা রাফিয়াকে একাই লালন পালন করেছে সে। কোনদিন মেয়ের মুখে গরম খাবার তুলে দিতে পারেনি! বাসা বাড়িতে কাজ করে উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে এসে মা-মেয়ে ভাগাভাগি করে খেয়েছে। বছরে একবার শুধু রোজার ইদে কাপড় কিনে দিতে পেরেছে মেয়েকে। মানুষের পুরনো কাপড় পরিধান করেই বছর পার করতে হয়েছে।
বাড়ি ফিরে দুয়ারে এসে নুসরাত জ্ঞান হারায়। পাড়া-প্রতিবেশীরা ধরে কাছের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। নুসরাতের অবস্থা করুণ। চিকিৎসা করাতে হবে কিন্তু কে দিবে টাকা? ডাক্তার হতাশ! রোগী নিজে সুস্থ হতে চায় না। হাসপাতালে কিছুদিন থেকে বাড়িতে চলে আসে নুসরাত।
" শুনেছিস, রাফিয়ার মার কালা জ্বর হয়েছে! বাপ মরা মেয়েটার কপাল পুড়েছে।"
এলাকার মহিলারা আলোচনা করছে পরস্পরে।
" মেয়েকে তো বড়োলোকের ঘরে রেখে এসেছে। আর নিজের তো কালা জ্বর হয়েছে, ক'দিন পর মেয়েরও হবে দেখিস! বড়োলোক বাড়ির সবাই মরবে, সবাই!
" এসব ছোঁয়াচে রোগ। আমরা থাকলে আমাদেরও হবে। চল চল!"
টিনের ঘরে একটা পাটি বিছিয়ে চোখের জল ফেলছে নুসরাত। সমাজের কুসংস্কারের জন্য কোথাও ঠায় মিলছে না তার। মেয়েকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভয়ে যেতেও পারছে না। তার ছোঁয়াতে সত্যিই যদি মেয়ের কালা জ্বর হয়? পাড়া-প্রতিবেশীরা কাছে ঘেঁষতে চায় না। আপনজন বলতে তেমন কেউ নেই তার।
দীর্ঘ ছয়মাস পর নুসরাত মেয়েকে দেখতে আসে। রোগা পাতলা রাফিয়ার শরীর ফুলেছে, গাল চিকচিক করছে। পরিধানে নতুন পোশাক। নুসরাত অবাক নয়নে মেয়েকে দেখছে। হেলেদুলে রাফিয়া মায়ের কাছে এসে স্তব্ধ বনে যায়। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে। মুখ শুকিয়ে কাঠ! মায়ের পাশে বসে আদুরে স্বরে বলে ছোট্ট রাফিয়া, " মাগো! তুমি কী খাও না?"
" কই খাই তো।"
" শুকিয়েছ কেন? আমার কথা খুব মনে পড়েছে বুঝি?"
নুসরাত দূরে সরে বসছে। রাফিয়াকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না কাছে।
" ও মা! কতদিন পর এলে! দূরে যেয়ো না।
" আমার অসুখ তোর গায়ে না লাগুক মা। দূরে থাক, তোকে মন ভরে দেখি।"
পঞ্চাশ বছর বয়সী রাবেয়া বেগম মা মেয়ের কথোপকথন শুনছিল। রাফিয়াকে তিনিই দত্তক নিয়েছেন। আদরে ভালোবাসায় বড় করবেন, ডাক্তার বানাবেন। নুসরাতের কাছে এসে বলেন, " ছোঁয়াচে বলতে কোন রোগ নেই। মা সন্তানের কাছে আসলে সন্তান নিরাপদেই থাকে। তুমি মন ভরে মেয়েকে আদর করো। রাফিয়ার সাথে তোমার অসুস্থতার দায়িত্বও আমি নিলাম।
মা-মেয়ের অন্তরে প্রশান্তি ফিরে আসে। স্রষ্টার কাছে হাজার শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। এমন মানুষ আদৌ কি দুনিয়াতে আছে?
কালা জ্বর নিয়ে যে প্রতিবেশীদের অন্তরে কুসংস্কার রটেছিল তাদের ভুল ভ্রান্তি দূর করতে রাবেয়া বেগম নুসরাতকে ঘরে তোলেন। চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন তিনি।
নুসরাত-রাফিয়া খুব ভালো আছে এখন। নুসরাত রাবেয়া বেগমের বাড়িতে কাজ করছে। চোখের সামনে মেয়েকে বড় হতে দেখছে। বছর পার হয়েছে। অতিবাহিত হয়েছে দীর্ঘ একটা সময়। রাফিয়া আজ ডাক্তার হয়ে বের হয়ে এসেছে। সকলের চোখে মনি সে। পঁচাত্তর বছর বয়সী রাবেয়া বেগম লাঠি ভর করে এসেছেন রাফিয়ার চেম্বারে। সাথে নুসরাতকেও নিয়ে এসেছেন।
রাবেয়া বেগম এবং নুসরাত কেবিনে প্রবেশ করে। নুসরাত সবকিছু ছুঁয়ে দেখছে। রাফিয়া আবেগপ্রবণ হয়ে নরম স্বরে বলে, " মাগো! সেদিন যদি তুমি আমায় সাথে করে নিয়ে না আসতে তাহলে আজকে এই সাদা এপ্রোন আমার গায়ে থাকতো না!"
" পৃথিবীতে সব মা চায় তার সন্তান বড় হোক। আমার সাধ্যে কিছুই ছিল না মা! তোর বড় মা পাশে ছিল বলেই আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।"
রাফিয়া হাসে। চেয়ারে আসন পেতে বসে বলে, "কুসংস্কার নয়, চিকিৎসায় অসুস্থতার সমাধান!"
সমাপ্ত
মাতৃস্বপ্ন
#আফসানা_মিমি
2 Comments
Nice and It's helpfull for anyother life dream.
ReplyDeleteThanks
Delete