অদৃশ্য এক সত্তা। নতুন উপন্যাস।

#অদৃশ্য এক সত্ত্বা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৭ /শেষ পর্ব (শেষাংশ)

আমার অবস্থার উন্নতি হওয়া শুরু করল। আমার রোগ নির্ণয়ের পর আমার সঠিক চিকিৎসা  চলতে লাগল। আস্তে আস্তে আমি একটু স্বাভাবিক হতে লাগলাম। নিয়মিত কাউন্সিলিং করায় সুইসাইডের প্রবণতাও চলে গেছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। পিঠের ক্ষতটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে ব্যথাও কমে গেল। মাথাটা মাঝে মাঝে টন টন করে ব্যথা করলেও ইনজেকশন দিলে সেটা একটু কমে যায়।  

অপরদিকে এতদিন হাতে পায়ে ক্যালুনা দিতে দিতে হাত পা ও যেন ক্যালুনা নিতে পারছিল না। ক্যালুনা দিলেই কিছুক্ষণ  পরেই তা আউট হয়ে যেত আর তীব্র ব্যথার সঞ্চার  হত। তাই বেশিরভাগ সময় সরাসরিই ইনজেকশন দেওয়া হত। মাথার চুল পড়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। মাথায় যখনই হাত দিতাম তখন অজোরে চোখ দিয়ে পানি পড়ত। হাঁটু সমান লম্বা চুলগুলো কেটে ঘাড় অবধি করেছে। চুল ও দশ ভাগের নয় ভাগ পড়ে একভাগ আছে। সবমিলিয়ে আমাকে ন্যাড়া করে দেওয়া হলো। এমনিতেও চুলের যত্ন হয় না তাই চুলগুলো একেবারে ফেলে দিল।

কঙ্কাল  সাড় দেহ আমার সারাদিন লেপ্টাইয়া বিছানায় পড়ে থাকত। শারীরিক অবস্থা পূর্বের থেকে উন্নতি হলেও কেমন যেন অবসাদ অবসাদ লাগত। মাঝে মাঝে মনে হত কেউ আমাকে এসে ধুমরে মুচরে দিচ্ছে। দূর থেকে কেউ এসে গলা চেপে ধরতে চাচ্ছে এমন মনে হত। মাঝে মাঝে হালকা কান্নার সুর শুনতে পারতাম।  রাকি অবশ্য মাকে বলে দিয়েছিল এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আর সে সময় টায় আমি সেন্সে থাকলে আমি যেন আমল করি আর আমার অবস্থা ভালো না হলে মা যেন সেগুলো আমল করে। তাই যখনই আমার এমন মনে হত আমি আমল করতে থাকতাম। আমল করতে করতে লক্ষ্য করতাম সব ধরণের আজগুবি ঘটনা গুলো হুট করেই বন্ধ হয়ে যেত। যা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর মনে হত। 

আমার চিকিৎসার ও উন্নতি হতে লাগল। আস্তে আস্তে আমি সুস্থ হতে লাগলাম। টানা তিন মাস হাসপাতালের বেডে কুকড়ে যেতে যেতে হঠাৎ  করে যেন আমি সজীব হতে লাগলাম। আমি সে সময় চিবিয়ে কিছু খেতে না পারলেও মুখ দিয়ে খেতে পারাতাম। তাই সব খাবার বেটে চটকে স্যুপের মতো করে দিত। আস্তে আস্তে আমার স্বাস্থ্য ঠিক হতে লাগল। আমি উঠে দাঁড়াতে পারলাম। যেদিন আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল এক মুঠো খুশি আমার জীবনটাকে রঙিন করে দিয়েছে। সেদিন দাঁড়াতে পারলেও পায়ে তেমন ভর না পাওয়ায় দুই তিন পা হাঁটতেই থুবরে পড়েছিলাম। রাত তখন একটা বাজে। নীচের পড়তেই যখন সামনের দিকে তাকালাম তখন মনে হলো এক বিভৎস নারী আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি সে সময়টায় ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম না। বরং রাকির বলে দেওয়া আমলগুলো করতে লাগলাম। সাথে সাথে বিভৎস মুখটা বিলীন হয়ে গেল। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। 

সেদিনের পর থেকে যতবারেই আমার মনে হত কোনো অশুভ কিছু আমাকে হানা দিচ্ছে ততবারেই আমি আমলগুলো করতাম। এতে করে সাথে সাথেই আমি একটা স্বস্তি অনুভব করতাম। এদিকে আমার শারিরীক বেশ উন্নতি হলো। সঠিক চিকিৎসা  হওয়ায় আমার চিকিৎসার উন্নতিও হলো এবং আমি সুস্থ হতে লাগলাম ধাপে ধাপে।

এতদিন আমার শরীর শুধু মুছিয়ে দেওয়া হত।  আজকে প্রায় তিনমাস পর আমাকে গোসল করানো হবে। মা রাকির কথা মতো কোথায় থেকে যেন বরই পাতা জোগার করে এনেছে এবং একটা বালতিতে গরম পানি নিয়ে তাতে বরই পাতা দিল। তারপর একটা মগে করে পানি এনে বেডে বসে কিছু আমল করল। তারপর মগের পানিতে ফু দিয়ে বালতির পানিতে মিশালো। এরপর আমাকে সে পানি দিয়ে মা গোসল করালো।

এতদিন পর গোসল করতে পেরে আমার ভেতরটাও বেশ প্রশান্তিময় হতে লাগল। মনে হচ্ছিল আমার শরীরে কিছু ভর করে ছিল আর সেটা এখন দূর হয়েছে। এরপর টানা সাতদিন হাসপাতালেই আমাকে এভাবে মা গোসল করাত। এবার আমি দ্রূত সুস্থ হতে লাগলাম। এবং আমার শারিরীক উন্নতি এতই দ্রূত হলো যে ডাক্তারাও বেশ অবাক হচ্ছিল। যে জায়গায় ডাক্তাররা একটা সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল সে জায়গায় আমি বেঁচে ফিরছি তার উপর এত দ্রূত সুস্থ হচ্ছি এটা সত্যিই অকল্পনীয় ছিল। 

অনেক ঝড় ঝাপটার পর আমাকে রিলিজ দেওয়া হলো টানা তিনমাস পর। অনেকটা সুস্থ। স্বাভাবিক ভাবে চলতে ফিরতে পারছি। যেদিন আমি বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিনের দৃশ্যটা এখনও আমার চোখে ভাসে। সারা বাড়িতে মানুষের সমাগম। সবাই আমাকে দেখতে এসেছে। সবার মধ্যে একটায় উত্তেজনা এর জন্য যে যার মৃত্যুর খবর শুনেছিল আজ সে মানুষটায় জ্যান্ত ফিরেছে। এত মানুষ দেখতে আসলেও আমার বাসার ভেতর পর্যন্ত  কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। কারণ ডাক্তারের কড়া নিষেধ ছিল। ডাক্তার বলেছিল আমাকে নিরিবিলি রাখতে। 

বাসায় আসার পরও আমার চিকিৎসা  চলতেছিল। শারিরীক ভাবে অনেক সুস্থ হলেও কিছু কিছু দিকে আমি বেশ অসুস্থ ছিলাম। যেমন আমার হুটহাট হাত, পা কাঁপত বুক ধরফর করত। আর এ সমস্যাটা আমার এখনও রয়ে গেছে। এরপর টানা নয়মাস ডাক্তারের  ফলোআপে এবং রাকির চিকিৎসা  নেওয়ার পর আমি পুরোপুরি সুস্থ হই।

ডাক্তারের ভাষ্যমতে আমি হুট করে এভাবে এত দ্রূত সুস্থ হয়ে যাব উনারা ভাবতেও পারেনি। এমনকি শেষ ফলোআপের রিপোর্ট দেখে ডাক্তারও অবাক হয়েছিল। কারণ আমার রিপোর্ট  এতই ভালো এসেছিল যে পূর্বে আমি কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলাম। অথবা আমার এত সূচণীয় অবস্থা হয়েছিল এটা বুঝায় যাচ্ছিল না। ডাক্তাররা সে সময় টায় আমাকে সাহসী যোদ্ধা বলতে লাগল। আমি সে সময়টায় প্রতিটা ডাক্তারের ভালোবাসা পেয়েছিলাম। আমাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে সবাই অনেক উৎসাহ দিয়েছে। সে সময়টা কোনো কোনো ডাক্তার ভিজিটের মোটা অঙ্কের টাকায় তারা নেয় নি। সে হিসাব করলে ২০১২ সালের মতো সময়ে হাসপাতালে আড়াই লাখ টাকার বিল তারা নেয় নি। আর এ বিলগুলো ছিল ডাক্তারদের ভিজিট।  তারা তাদের ভিজিটও নেয় নি এবং অনেক চিকিৎসায় ডিসকাউন্ট  ও দিয়েছে। সব মিলে বাবা মায়ের দোয়া, সকলের ভালোবাসা এবং আল্লাহ অশেষ রহমতে আমি সুস্থ হই আলহামদুলিল্লাহ। 

বিষয়টা প্যারানরমাল কি'না জানি না। তবে হুট করে সুস্থ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা সবাইকে একটু হলেও ভাবিয়ে তুলেছিল। তবে বিষয়টা যে কিছুটা প্যারানরমাল ছিল তা টের পেয়েছি ২০২২ সালে। ২০১২ সালের পর আমার তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।  জীবনে অনেক উত্থান  পতন গিয়েছে তবে সেটা সংগ্রাম করে পার ও করে ফেলেছি।  তবে ২০২২ সালে এসে আমার কেবল মনে হত আমার সাথে কেউ আছে। কেউ দূর থেকে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে তবে পারছে না। অকারণে রাগ উঠে যেত। কারণে অকারণে কাঁদতাম। সুইসাইড করার ভীষণ ইচ্ছা করত। অযথায় ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। হুট করে অসুস্থ হয়ে যেতাম।  ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে লক্ষ্য করত সব ঠিক আছে। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা এই ভালো এ  খারাপের মধ্যে যাচ্ছিল। আবারও স্বাস্থ্য নষ্ট হতে শুরু করল। চুল পড়তে শুরু হলো। 

অনেক চিকিৎসা  করার পরও আমার তেমন রোগ ধরা পরছে না। বিয়ের কথা শুনলেই আমার রাগ উঠত। বিষয়টা  আবার ২০১২ সালের দিকে মোড় নিতে নিল। এবার আমার মায়ের মনে খচখচ করতে লাগল। মা আবার আমাকে রাকি দেখাল। রাকি যখন তিলাওয়াত  করত আমার দম বন্ধ হয়ে যেত,বমি আসত, মাথা ব্যথা করত, চোখ দিয়ে এমনেই পানি পড়ত। সব মিলিয়ে রাকি জানাল আমার সাথে বদজিন আছে যারা দূর থেকে ক্ষতি করার ট্রাই করতেছে। আমার যেন বিয়ে নাহয় তার জন্য বান মারা হয়েছে। আরও কিছু বিষয় যেগুলো সবার সামনে উপস্থাপন সম্ভব না। এরপর আমি ২০২২ এর আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত  রাকি যেভাবে বলেছে সেভাবে আমল করে আসছি। এবং আস্তে আস্তে আমার সমস্যা গুলো কাটতে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ  বিয়ে নিয়ে সমস্যা ছিল সেটাও এ গল্প লিখতে লিখতে হয়ে গেল। যার দরুণ গল্পটা দিতে এত দেরি হলো। 

আমার কাছে বিষয়টা ২০২২ এর আগে মনে হত আমার মনের ভুল ছিল তাই এরকম প্যারানরমাল বিষয় ঘটেছে। তবে ২০২২ এর পর থেকে আমার মনে হয় বিষয়টা প্যারানরমালেই ছিল।

জানি না বিষয়টা কী ছিল হতে পারে আমার মানসিক বিপর্যয়ের জন্য এমনটা হয়েছে নাহয় পুরোটাই প্যারানরমাল ছিল। বিষয়টা যাইহোক তবে সে সময়ের যন্ত্রণাটা আমি কখনও ভুলব না। আমার জন্য দোয়া করবেন। এরকম পরিস্থিতিতে কখনও যেন কাউকে না পরতে হয় সে দোয়া করি। 

আর হ্যাঁ এটাই আপনাদের লেখিকা শারমিন আঁচল নিপার সাথে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা। 

সমাপ্ত।

Post a Comment

0 Comments